(Bengali-বাঙালি) মিয়ানমার – রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা হুমকি নয়

ORIGINAL LANGUAGES, 25 Dec 2017

মং জার্নি - প্রথম আলো

১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ – মং জার্নিএটা কি কল্পনা করা যায়, বিবিসি, চ্যাটহ্যাম হাউস, রান্ড করপোরেশন অসউইচসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন কুখ্যাত নির্যাতন শিবিরের বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের সম্ভাব্য ‘ইহুদি সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে? আবার এটাও কি ভাবা যায় যে ছোট ছোট ইহুদি ছেলেমেয়েদের ‘সম্ভাব্য ইহুদি সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে? যদিও তাদের মধ্যে হয়তো স্বাভাবিকভাবে প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নিয়েছিল? যাদের বাবা-মাকে হিটলার গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল। তবে নিশ্চিতভাবে এসব কিছু তখন ঘটেনি।

মং জার্নি এবং অং সান সু চি

কিন্তু আজ মিয়ানমারের বৌদ্ধদের পরিচালিত গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের বেলায় এ কথা বলা হচ্ছে। যাদের নাম মিয়ানমারের ক্যাথলিক চার্চ, এমনকি পোপ পর্যন্ত মুখে আনেননি, পাছে এই গণহত্যার নেতা সেনাপ্রধান মিন অং লেইং ও অং সান সু চি বিরক্ত হন। বাস্তবতা হলো প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা দ্বিমুখী নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। প্রথমত, তারা ফেরত গেলে উত্তর আরাকানে নিপীড়িত হওয়ার আশঙ্কা আছে; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশেও তারা সম্ভাব্য হুমকির মুখে আছে।

রোহিঙ্গাদের জন্মস্থান মিয়ানমার আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাঙালি অভিবাসী’ আখ্যা দেয়, এটা ভ্রান্ত। আরও খারাপভাবে বললে তাদের ‘জিহাদি সম্প্রদায়’ বলে আখ্যা দেয়। মিয়ানমারের নাগরিক সমাজে এই ধারণাটা সামগ্রিকভাবে জনপ্রিয় ও প্রসারিত হয়েছে, তাদের অবস্থাটা এখন ১৯৩০-এর দশকের জার্মানদের মতো। মিয়ানমারের মানুষের চোখে রোহিঙ্গারা তাদের ‘বৌদ্ধ জীবনযাপনের’ প্রতি হুমকিস্বরূপ, শুধু তা-ই নয়, জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিও। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিলেও দেশটির এ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ আছে। কারণ, এতে সে কিছু ‘অপ্রথাগত নিরাপত্তা হুমকির’ সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে আছে মহামারি, দেহব্যবসা, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি। অন্যদিকে এরা ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের দলে ভিড়ে যেতে পারে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রবিহীন এই জাতিগোষ্ঠীর ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের যেমন ভুল ধারণা আছে, তেমনি এই ভুল ধারণার পালে বিভিন্ন পরামর্শক ও সাংবাদিকেরাও হাওয়া দিচ্ছেন। তাঁরা নানা রকম ‘নিরাপত্তা বিশ্লেষণ’ হাজির করছেন। আবার এখন এ নিয়ে অনেক খবর আসছে যে রোহিঙ্গা এতিম, নারী ও কিশোরীরা এখন স্থানীয় বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়েছে। এরা এখন এই মেয়েদের দিয়ে পতিতাবৃত্তি, মাদক ব্যবসা বা বাঁধা শ্রমিকের কাজ করাবে।

তবে গভীর সমস্যা হচ্ছে ভদ্রলোকি অপরাধ, আমি যার নাম দেব রোহিঙ্গাদের প্রতীকী শোষণ। এর মধ্যে আছেন গবেষক, সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবী, যাঁরা বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁরা এসব প্রতিবেদন প্রণয়ন করছেন কিছু ধারণার আলোকে। সেগুলো হচ্ছে ‘মুসলিম বিদ্রোহ’, ‘আমূল ইসলামি সংস্কারবাদ’, ‘মৌলবাদী সন্ত্রাস’ ইত্যাদি।

আর এই ধাক্কায় যে ৬ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা চলে এল, তার মধ্যে ৬০ ভাগই হচ্ছে ভীতসন্ত্রস্ত নারী ও শিশু, দুর্বল বৃদ্ধ মানুষ। ফলে গয়রহভাবে তাদের ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার হুমকি’ বা আইএসের দলভুক্তকরণের সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হিসেবে আখ্যা দেওয়াটা তাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যার মতোই বিতৃষ্ণাকর। এই ভদ্রলোক সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রামের ছিঁচকে অপরাধীদের মতোই অনৈতিক, তাদের চেয়ে বেশি না হলেও। এই উভয় গোষ্ঠী নিজেদের পকেট ভরতে পৃথিবীর সবচেয়ে অরক্ষিত গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে। এদের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে তারা নিজেদের বিশেষজ্ঞ ভাবমূর্তি গড়ে তোলে, তখন তারা ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘নিরাপত্তা’ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি পায়।

এই গভীর ক্ষোভ হজম করে আমি নিজেকে এসব থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন, সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়, রাজনৈতিক আলোচনা, সাক্ষাৎকার পড়তে বাধ্য করেছি; যেখানে রাজনীতিক, পরামর্শক, এনজিও ও সাংবাদিকেরা বলে থাকেন যে বাংলাদেশে চরমপন্থা বিস্তারের আশঙ্কা আছে। সেখানে সতর্কতার সঙ্গে বলা হয়, ‘মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ’। এই ‘নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা’ স্থূলভাবে এই সত্য অস্বীকার করেন যে কেউ তাদের ওপর বোমা মারেনি, সেটা যেমন মিয়ানমারে, তেমনি বাংলাদেশে। সেই ৩৯ বছর আগে মিয়ানমার প্রথম যখন উত্তর রাখাইনে গণহত্যা শুরু করে, তখন থেকে এ পর্যন্ত তারা পৃথিবীর কোনো দেশে বোমা মারেনি।

বিশ্বের সরকার ও গণমাধ্যমের কাছে আমার অনুরোধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিধনযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষকে যেমন যথাযথভাবে রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন দেওয়া হয়েছিল, রোহিঙ্গাদেরও যেন সে রকম সমর্থন দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বশক্তি ও গোয়েন্দারা কেন এসব ভুল ব্যাখ্যা গ্রহণ করে? এর উত্তরে আমি দুটি সংক্ষিপ্ত ও পরস্পর সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দেব: একটি হচ্ছে ইসলামভীতি, আরেকটি হলো নির্যাতনের বদ্ধমূল ধারণাঘটিত মানসিক বৈকল্য, যার ওপর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নির্ভর করে।

প্রথমত, এসব সংস্থা ও সেখানে কর্মরত নারী-পুরুষ প্রাতিষ্ঠানিক ও মানসিকভাবে মানুষকে সম্ভাব্য অপরাধী হিসেব দেখে থাকে; যেখানে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ অন্য মানুষকে শোভন, সম্ভাব্য বন্ধু, ভালোবাসার মানুষ বা অংশীদার হিসেবে দেখে। আমার বাবার একজন প্রিয় বন্ধু, যিনি কর্মজীবনে মিয়ানমারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ক ছিলেন, তিনি আমার এই ধারণাটা আরও পাকাপোক্ত করেছেন যে গোয়েন্দাদের ক্ষেত্রে এটা এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ভ্রম।

দ্বিতীয়ত ও শেষত, ৯/১১-এরপর পশ্চিমা গণমাধ্যম ও শক্তিশালী সংস্কৃতি শিল্প যেমন হলিউড প্রাচ্যবাদী (পড়ুন বর্ণবাদী) ধারণার বশবর্তী হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করে। তারা বলতে থাকল, এদের বোধ-বুদ্ধি নেই, এরা নির্মম, সংকীর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল। যদিও ‘খ্রিষ্টান পশ্চিমা’ বিশ্ব গত ১০০ বছরে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ।

এসব বলতে বলতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ (হলোকাস্ট), স্নায়ুযুদ্ধ, ডেথ স্কোয়াড, গুলাগ, কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের কথা মাথায় আসে। তবে এর মধ্যে ৫০০ বছরের গির্জাভিত্তিক এবং গির্জার অর্থায়নে পরিচালিত ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের গণহত্যার কথা কিন্তু আসেনি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এখন মিয়ানমারের গণহত্যা, জাতিগত নিধনযজ্ঞ, মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ও গণপরিসরে স্বীকৃতি দিতে হবে অথবা তাকে অন্য নামে স্বীকৃতি দিতে হবে।

_________________________________________

মং জার্নি: পাশ্চাত্যে বসবাসরত মিয়ানমারের মানবাধিকারকর্মী গণহত্যা বিশেষজ্ঞ

Go to Original – prothom-alo.com

Share this article:


DISCLAIMER: The statements, views and opinions expressed in pieces republished here are solely those of the authors and do not necessarily represent those of TMS. In accordance with title 17 U.S.C. section 107, this material is distributed without profit to those who have expressed a prior interest in receiving the included information for research and educational purposes. TMS has no affiliation whatsoever with the originator of this article nor is TMS endorsed or sponsored by the originator. “GO TO ORIGINAL” links are provided as a convenience to our readers and allow for verification of authenticity. However, as originating pages are often updated by their originating host sites, the versions posted may not match the versions our readers view when clicking the “GO TO ORIGINAL” links. This site contains copyrighted material the use of which has not always been specifically authorized by the copyright owner. We are making such material available in our efforts to advance understanding of environmental, political, human rights, economic, democracy, scientific, and social justice issues, etc. We believe this constitutes a ‘fair use’ of any such copyrighted material as provided for in section 107 of the US Copyright Law. In accordance with Title 17 U.S.C. Section 107, the material on this site is distributed without profit to those who have expressed a prior interest in receiving the included information for research and educational purposes. For more information go to: http://www.law.cornell.edu/uscode/17/107.shtml. If you wish to use copyrighted material from this site for purposes of your own that go beyond ‘fair use’, you must obtain permission from the copyright owner.

Comments are closed.